সুগৃহিণী শব্দটি রান্নার সাথে জড়িত। রান্নার জগতের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত কিছু শব্দ আছে, যেগুলোকে মূলতঃ এ জগতেরই পরিভাষা বলা হয়। আর কিছু শব্দ আছে যা বস্তু বা পদার্থের। এখানে সে দু’ধরনের কিছু বিশেষ শব্দের বিষদ অর্থ ব্যক্ত করলাম। সব শব্দ দিয়ে আলোচনার প্রয়োজন দেখি না। কেননা, রাঁধুনীরা মোটামুটি সেগুলির সাথে পরিচিত। অপরিচিত শব্দগুলি এখানে উল্লেখ করবার দরকার হল শুধুমাত্র তাদের জ্ঞাতার্থে। রাঁধুনীরা এতে উপকৃত হবেন আশারাখি।
পোড়া
শাক, তরিতরকারি, মাছ, মাংস উনানে গরম ছাইয়ের উপর কিংবা কয়লার উপর রেখে উল্টেপাল্টে ঝলসানোকে ‘পোড়া’ বলা হয়। পোড়াবার সময় সাধারণতঃ ঝাল, লবণ, তেল মাখিয়ে নিতে হয়। কখনও কখনও পাতা বা ঐরকম কোন জিনিস জড়িয়ে পোড়ানো যায়।
ফোড়ন
তরকারি সাঁতলানোর সময় ঘি বা তেলের উপর যেসব মসলা দিয়ে তরকারি সুদন্ধ করা হয়, তাকে ‘ফোড়ন’ দেওয়া বলে। তেজপাতা, জিরা, সরিষা, মৌরি, কালোজিরা, পাঁচফোড়ন প্রভৃতিকে ফোড়নের মসলা বলে।
ভাজার মাছ
নরম করে ভাজার মাছ-ইলিশ, খলসে, কই ইত্যাদি।
মুচমুচ করে ভাজার মাছ
পুঁটি, ভাটা, কুচোচিংড়ি, মৌরলা ইত্যাদি।
লালচে করে ভাজার মাছ
রুই, কাতলা, কালিবাউস, মৃগেল, মহাশোল ইত্যাদি।
পুড়িয়ে খাবার মাছ
টাকি, শোল, মাগুড়, শিং।
হাতাপোড়া
অনেক সময় সমস্ত ডাল বা ঝোল ঢেলে সাঁতলাতে বড় অসুবিধা দেখা দেয়। সেজন্য একটা হাতায় তেল গরম করে ফোড়ন ছেড়ে দেওয়া হয়। ফুটে উঠলে হাতাটা ডালে বা ঝোলে ডুবিয়ে দেবেন। একে ‘হাতাপোড়া’ ফোড়ন বলে।
গ্রেভী
নানা উপায়ে ‘গ্রেভী’ করা যায়। গ্রেভীকে একরকম ‘কারি’ বলা যেতে পারে। কারিতে নানা রকম জিনিস যেমন পেঁয়াজ, আদা, রসুন, নারকেল, পোস্ত দানা প্রভৃতি দিয়ে ঘন করে পারলেই ‘গ্রেভী’ হয়। এসব জিনিস কারিকে ঘন করা চাড়া রান্নায় সুগন্ধ এনে দেয়। গুঁড়ো করা, পেষা এবং কুচি করে কাটা জিনিসের পরিমিত ব্যবহারের উপর গ্রেভীর সুস্বাদু নির্ভর করে। নানাভাবে কমবেশী ও বিভিন্ন প্রকারের মসলা দেয়ার উপর ‘গ্রেভীর’ সুস্বাদু নির্ভর করে।
চাপড়ঘণ্ট
চাপড়ঘণ্ট শুক্তোর পর্যায়ভুক্ত। এতে তরকারি বেশ মিহি করে কুটতে হয় এবং ঘণ্টর মত লথলথে করে রান্না করতে হয়। বেশ খানিক মটরডালের চাপড়ী ভেজে ঘণ্টের সাথে মেশানো হয় বলে এর নাম চাপড়ঘণ্ট। প্রথমে মটরডাল মিহি করে বেটে চাপড়ী ভেজে নেবেন। গরম তেলে তেজপাতা, মরিচ, পাঁচফোড়ন ও সরষেফোড়ন দিয়ে তরকারিগুলো ঝলসিয়ে নেবেন। তারপর পরিমাণমত লবণ, হলুদ ও অল্প পানি দিয়ে নেড়েচেড়ে বেশ লথলথে হলে অল্প ঘি ও আদাবাটা দিয়ে নামিয়ে ফেলবেন।
সাঁতলান
গরম তেলে মাছ আধ-ভাজা করে, আমিষ ও নিরামিষ তরকারি সুবাসিত করার জন্য গরম ঘি বা তেলে সম্বরা দেওয়া হয়।
সম্বরা
সম্বরা অর্থাৎ ফোড়ন দেওয়া; তেলে কিংবা ঘিতে গরম করে তাতে পাঁচফোড়ন, মরিচ, তেজপাতা প্রভৃতি দিয়ে সিদ্ধ করা ডাল ঢেলে দেওয়াকে সম্বরা বলে।
কালিয়া
ঝাল ও কালিয়া প্রায় একই ধরনের। তবে কালিয়াকে ঝালের গুরুপাক বলা যেতে পারে। কালিয়া ঝালের মতই রান্না করতে হয়। তবে গোটা গরমমসলা ও পেঁয়াজ ফোড়ন দিতে হয়। নামাবার আগে ঘি ও গরমমসলা বাটা দিয়ে নামাতে হয়। নিরামিষ কালিয়াতে পেঁয়াজ ও রসুনবাটা বাদে সবই দেওয়া চলে।
রায়তা
এই জিনিসটা অনেকের প্রিয় খাবার। নানাভাবে একে প্রস্তুত করা যায়। দইকে বারবার বেড়ে পরিষ্কার করতে হবে; তারপর এতে গোলমরিচের গুঁড়ো, ধনেপাতা, কাঁচা মরিচ ও অন্যান্য মসলা দিতে হবে। এই খাবার ঠান্ডা অবস্থায় খেতে দিতে হয়।
বেক
শুষ্ক উত্তাপে রান্না করাকে ‘বেক’ বলে। সাধারণতঃ এটা বদ্ধ পাত্রে কিংবা ওভেনে করতে হয়। আমাদের দেশে এই বেকিং প্রথার প্রচলন সামান্য। বিভিন্ন দেশে এই রকমের বেকিং প্রথা আছে-যাকে বলে ‘তন্দুর’।
ময়ান
সাধারতঃ লুচি বা পরোটা তৈরি করবার পূর্বে আটা বা ময়দার সঙ্গে যে ঘি মেশানো হয়, তাকে ‘ময়ান’ দেওয়া বলে।
কাস্টার্ড
দুধ, চিনি ও ডিমের মিশ্রিত রান্নাকে ‘কাস্টার্ড’ বলে।
কারিপাতা
কারিপাতা বলতে এক ধরনের গাছের ছোট ছোট পাতাকে বোঝায়। সাধারণতঃ পোলাও, তরিতরকারি প্রভৃতি রান্নাতে দেওয়া হয় সুগন্ধ করবার জন্য। সব রকম রান্নায় এই পাতা গোটা দেয়া হয়।
বেদনাবিচি
সাধারণঃ খাবার সুগন্ধ করবার জন্য ‘বেদনাবিচি’ ব্যবহার করা হয়। পাকোড় বড়া প্রস্তুতে এর গুঁড়ো দেয়া হয়।
জায়ফল
এক ধরনের সুগন্ধযুক্ত ফলে শাঁস। এর দ্বারা রান্না সুগন্ধি করা হয়।
পনির
কারি বা পোলাওয়ে পনিরের খুব প্রয়োজন। একে এই আকারে আনতে হলে ভারী জিনিস দিয়ে ঘন্টাদেড়েক চেপে রাখতে হবে যাতে এই ছানা পুরোপুরি ক্তি জিনিসে পরিণত হয়। ভারী চাপটা তুলে খুশিমত যে কোন আকারে পনির কেটে নেবেন। পুরি, চাপাতির জন্য যে ময়দা মাখতে হয়, তাতে পানি দিয়ে না মেখে এই পনিরের পানি দেয়া চলে।
খোয়া
শুকনো ক্ষীরকে ‘খোয়া’ বলা হয়। খোয়া অনেকদিন পর্যন্ত ভালো অবস্থায় রাখা যায়। দুধের জলীয় অংশ শুকিয়ে এটি প্রস্তুত করা হয়। খোয়াক্ষীরে ভালো পিঠে হয়। এছাড়া বাজারে তৈরি খোয়াক্ষীরও কিনতে পাওয়া যায়।
মোরব্বা
পরিষ্কার চিনির রসে আধাসিদ্ধ ফল ইত্যাদিকে আবার কমবেশি সিদ্ধ করে নিলে মোরব্বা তৈরি হবে। মোরব্বা ভাল ভাবে তৈরি কাঁচের পাত্রে রাখলে অনেকদিন থাকে। সেজন্য চিনির রস যতদূর সম্ভব পরিষ্কার হওয়া দরকার। রসে ‘গাদ’ থাকলে মোরব্বা শিগগির পচে যায়। যেসব জিনিসে বেশি পানি থাকে এরকম জিনিস দিয়ে মোরব্বা ভাল হয় না। মোরব্বার জন্য শক্ত ফলমূলাদি প্রয়োজন। ফলমূল অনুসারে চিনির অংশের ও জ্বালের তারতম্য হয়। মোরব্বা অনুসারে পাতলা বা একেবারে শুকনো রস করতে হয়। সাধারণতঃ বেল, আম প্রভৃতির মোরব্বা করা হয়।
কাসুন্দি
ঝাল, লবণ, টক ও মিষ্টি স্বাদ বিশিষ্ট জিনিসে সরষের গুঁড়োকে কাসুন্দি বলে। সেজন্য সরষের গুঁড়োই কাসুন্দির একমাত্র বিশেষত্ব। কাসুন্দিতে কাঁচা মরিচ ব্যবহার করা হয় না। কোন কোন কাসুন্দিকে রক্ষা করতে হয় তেল মিশিয়ে।
কোর্মা
পানি না দিয়ে কেবল দই দিয়ে আস্তে আস্তে কম তাপে রান্না করা মাংসের টুকরোকে ‘কোর্মা’ বলে। পাঁঠা বা ভেড়ার মাংসে কোর্মা ভাল হয়। বড় চিংড়ি ও রুই মাছেরও কোর্মা হয়। প্রায় এক কিলো মাংসে আধ কিলো টক দই লাগে।
কোপ্তা
মাংসের কিমা বলে আকারে তৈরি করে গ্রেভীতে রান্না করলে কোপ্তাকারি হয়। কিমার সাথে ছোলার ডালবাটা বেসন কিংবা ডিম না মেশালে ‘বলের’ বাঁধন ধরে না। কোপ্তা রান্নার পর ওপরে ক্রিম দেয়া হলে খেতে বেশ সুস্বাদু হয়।
কাবাব
মাছ ও মাংসে প্রয়োজনমত ঝাল, লবণি ইত্যাদি ও তার সাথে ঘি মাখিয়ে জ্বলন্ত উনানে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঝলসিয়ে নেয়ার নাম ‘কাবাব’। তাছাড়া মাংস বেটে নানারকম মসলা মাখিয়ে গোল গোল কাটলেটের মত অল্প ঘি বা তেলের ভাজাকেও কাবাব বলে। আর এরকম কাবাব হাঁড়িতে ঘিয়ে ভাজতে হয়-সেজন্য তার নাম ‘হাঁড়িকাবাব’। মাংস লোহার শিকে ফুঁড়ে আগুনের ওপর ধরে ঘুঁরিয়ে ঘুঁরিয়ে ঝলসিয়ে নেয়াকে ‘শিক কাবাব’ বলে। কুচি কুচি করে কাটা মাংস খোলা কাঠকয়লার উপর ভেজে কাবাব তৈরি করা হয়। যত রকম কাবাব আছে, তার মধ্যে শিক কাবাব ও শামি কাবাব শ্রেষ্ঠ। শামি কাবাব রান্না হয় বেশি ঘিয়ে ভেজে।