স্বাস্থ্যকর চুলের জন্য আমাদের শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণ পুষ্টি দরকার। এর মধ্যে রয়েছে বায়োটিন (ভিটামিন বি৭) এবং ভিটামিন ডি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই ভিটামিনগুলোর ঘাটতি হলে চুল পড়া শুরু হতে পারে।
মেঝেতে যদি কিছু চুল পড়ে থাকতে দেখেন ঘাবড়ে যাবেন না, কিছু চুল পড়া স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু চুল পড়ার পরিমাণ যদি বেশি হয়, তবে এর কারণ খুঁজে বের করা প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, মাথার ত্বকের সমস্যা, ভিটামিনের ঘাটতি, ভিটামিন ডি এর অভাব, ভিটামিন বি-১২, বি-৬ এবং বায়োটিন (বি-৭) এর অভাব। এই সমস্ত ভিটামিনের ঘাটতি হলে আপনাকে এগুলো দিকে নজর দিতে হবে।
চুল পড়া কি?
“যখন কারও দিনে ১০০টির বেশি পড়ে যায়, তখন তা স্বাভাবিক চুল পড়ার সীমা (৫০ থেকে ১০০ চুল) অতিক্রম করে।”
চুল পড়া একটি সহজাত প্রক্রিয়া, তবে বেশি চুল পড়া স্বাস্থ্যের সমস্যা বা জীবনযাপনে কিছু বাধার সম্মুখীন হতে পারে।
- মাথার ত্বকের সমস্যা: যেমন খুশকি বা সোরিয়াসিস চুল পড়ার কারণ হতে পারে।
- জীবনযাত্রার অভ্যাস: অতিরিক্ত ধূমপান, অ্যালকোহল সেবন, ব্যায়ামের অভাব এবং মানসিক চাপ চুল পড়া বাড়ায়।
- ভিটামিনের ঘাটতি: শরীরে পুষ্টির অভাবও চুল পড়ার একটি বড় কারণ।

কোন ভিটামিনের ঘাটতি চুল পড়ার কারণ?
ভিটামিন এবং খনিজ চুলের শিকড়ের (ফলিকলের) স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো চুলের সঠিক বৃদ্ধির জন্য দরকার। ২০১৮ সালে ডার্মাটোলজি অ্যান্ড থেরাপি জার্নালের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, এই পুষ্টির অভাব চুল পড়ার কারণ হতে পারে।
ভিটামিনের ঘাটতি যা চুল পড়ার কারণ:
১. থায়ামিন বা ভিটামিন বি 1
থায়ামিন (ভিটামিন বি১) চুলের শিকড় (ফলিকল) এবং শরীরের কোষগুলির শক্তি উৎপাদনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি কার্বোহাইড্রেট থেকে শক্তি তৈরি করতে সাহায্য করে, যা চুলের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, থায়ামিনের ঘাটতি হলে চুলের শিকড়ে যথেষ্ট শক্তি পৌঁছায় না, ফলে শিকড় দুর্বল হয়ে যায় এবং নতুন চুল গজাতে সমস্যা হয়।
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (NHS) অনুযায়ী, একজন প্রাপ্তবয়স্ক প্রতিদিন ২৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি১ গ্রহণ করতে পারেন।
এই সমস্যা কমাতে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং পুষ্টিকর খাবার খাওয়া জরুরি।
২. ভিটামিন বি 2 (রিবোফ্লাভিন)
ভিটামিনের ঘাটতি থেকে চুল পড়া হলে, রিবোফ্লাভিন (ভিটামিন বি২)-এর গুরুত্ব ভুলবেন না। এটি শক্তি উৎপাদন এবং চুলের শিকড়সহ স্বাস্থ্যকর টিস্যু তৈরিতে সাহায্য করে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, রিবোফ্লাভিন আয়রনের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করে, যা মাথার ত্বক ও চুলের শিকড়ে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখে।
ইউএস ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ অনুযায়ী, প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের প্রতিদিন গড়ে ৪.৭ মিলিগ্রাম রিবোফ্লাভিন গ্রহণ করা উচিত।
৩. ভিটামিন বি 5
প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড (ভিটামিন বি৫) ফ্যাটি অ্যাসিড এবং শক্তি উৎপাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি চুলকে মজবুত ও নমনীয় করতে এবং শিকড়ে পুষ্টি সরবরাহ বাড়াতে সাহায্য করে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্যান্টোথেনিক অ্যাসিডের ঘাটতি চুল পড়া ও চুল ভঙ্গুর হওয়ার কারণ হতে পারে।
ইউএস ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ অনুযায়ী, প্রতিদিন ৫ মিলিগ্রাম প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড গ্রহণ করা উচিত।
৪. ভিটামিন বি 6
পাইরিডক্সিন, যা ভিটামিন বি৬ নামে পরিচিত, চুলের বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি প্রোটিন ভাঙতে সাহায্য করে এবং হরমোন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে, যা চুলের স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয়।
ডাঃ ভাট বলেন, ভিটামিন বি৬-এর ঘাটতি চুল দুর্বল করে এবং চুল পড়া বাড়ায়।
ইউএস ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ অনুযায়ী, প্রতিদিন ১.৭ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি৬ গ্রহণ করা উচিত।
৫. ভিটামিন বি 7
কেরাটিন একটি প্রোটিন যা চুলের আকার ও বৃদ্ধি বজায় রাখে, এবং এর জন্য ভিটামিন বি৭ বা বায়োটিন প্রয়োজন। বায়োটিন শরীরে গ্লুকোজ, ফ্যাটি অ্যাসিড ও অ্যামিনো অ্যাসিড ভেঙে শক্তি তৈরি করতে সাহায্য করে এবং চুলের শিকড় সুস্থ রাখে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বায়োটিনের ঘাটতি হলে কেরাটিন তৈরি কমে যায়, যা চুল ভঙ্গুর হওয়া, চুল পাতলা হওয়া বা চুল পড়ার কারণ হতে পারে।
ইউএস ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ অনুযায়ী, প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতিদিন ৩০ মাইক্রোগ্রাম (এমসিজি) বায়োটিন গ্রহণ করা উচিত।
৬. ভিটামিন বি 9
ভিটামিন বি৯, যা ফলিক অ্যাসিড নামে পরিচিত, চুলের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি কোষের বৃদ্ধি ও মেরামত এবং চুলের শিকড়ের উন্নতিতে সাহায্য করে। পাশাপাশি, এটি লাল রক্তকণিকা তৈরি করে, যা চুলের বৃদ্ধির জন্য জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ফলিক অ্যাসিডের ঘাটতি হলে চুল দুর্বল হয়ে পড়ে, ধীরে বাড়ে এবং পাতলা হয়ে যেতে পারে।
ইউএস ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ অনুযায়ী, প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতিদিন ৪০০ মাইক্রোগ্রাম (mcg) ফলিক অ্যাসিড গ্রহণ করা উচিত।
৭.ভিটামিন বি 12
ভিটামিন বি১২, যা কোবালামিন নামে পরিচিত, চুলের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ। এটি লাল রক্তকণিকা তৈরি করে, যা মাথার ত্বক ও চুলের শিকড়ে (ফলিকলে) অক্সিজেন সরবরাহ করে। চুলের শিকড় ভালোভাবে কাজ করতে এবং চুলের বৃদ্ধি বজায় রাখতে এই অক্সিজেন ও পুষ্টি খুব দরকার।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভিটামিন বি১২-এর অভাব হলে চুলের শিকড় দুর্বল হয়ে যায় এবং চুল পড়তে শুরু করে।
ইউএস ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ অনুযায়ী, প্রতিদিন ২.৪ মাইক্রোগ্রাম (mcg) ভিটামিন বি১২ গ্রহণ করা উচিত।
৮. ভিটামিন ডি
ভিটামিন ডি চুলের শিকড় (ফলিকল) তৈরিতে সাহায্য করে, যা থেকে নতুন চুল গজায়। এটি নতুন চুলের শিকড় তৈরি করতে এবং চুলের পরিমাণ ঠিক রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস অনুযায়ী, ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি এড়াতে প্রতিদিন ১০ মাইক্রোগ্রাম (mcg) ভিটামিন ডি গ্রহণ করা উচিত।
৯. ভিটামিন ই
ভিটামিন ই চুলের স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমায় এবং মাথার ত্বক ও চুলের শিকড়কে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। ভিটামিন ই চুলের বৃদ্ধি বাড়াতে সাহায্য করে এবং এর অভাবে চুল পড়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
২০১০ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ভিটামিন ই চুল পড়া কমাতে এবং চুলের বৃদ্ধি বাড়াতে সাহায্য করেছে।
ইউএস ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ অনুযায়ী, প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতিদিন ১৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন ই গ্রহণ করা উচিত।
ভিটামিনের ঘাটতি যা চুলের ক্ষতি করে: এই পুষ্টি পাওয়ার উপায়
চুল পড়া রোধে ভিটামিনের ঘাটতি পূরণ করা খুবই জরুরি। নিচে গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন ও সেগুলো পাওয়ার উপায় উল্লেখ করা হলো:
- ভিটামিন বি৭ (বায়োটিন)
- উৎস: ডিম, বাদাম, গোটা শস্য, কলা।
- ভিটামিন বি৯ (ফলিক অ্যাসিড)
- উৎস: পালং শাক, ব্রকলি, ডাল, কমলা।
- ভিটামিন বি১২ (কোবালামিন)
- উৎস: মাছ, মাংস, ডিম, দুধ।
- ভিটামিন সি
- উৎস: লেবু, কমলা, স্ট্রবেরি, কিউই।
- ভিটামিন ডি
- উৎস: সূর্যের আলো, মাশরুম, ফ্যাটি মাছ।
- ভিটামিন ই
- উৎস: বাদাম, বীজ, সবুজ শাকসবজি।
পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার পাশাপাশি, প্রয়োজন হলে ডাক্তারের পরামর্শে সাপ্লিমেন্ট নিতে পারেন। নিয়মিত সঠিক খাদ্যাভ্যাস চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করবে।