উচ্চ রক্তচাপে করণীয়: কারণগুলি, প্রতিকার এবং চিকিৎসা

উচ্চ রক্তচাপে করণীয়: হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ অতি পরিচিত রোগ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রায় ১০-১৫ ভাগ মধ্যবয়সী বা তার অধিক বয়সী লোক এই রোগে ভুগে থাকে। আমাদের দেশে উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের মাঝে ৯০-৯২ ভাগ রোগীর বেলায় এই রোগের কারণ এখনো অজানা। বাকি ৮-১০ ভাগের ক্ষেত্রে কারণ পাওয়া গেলে তাও নির্ণয় করা খুবই কঠিন। সাধারণত কিডনিজনিত প্রদানের কারণে হাইপারটেনশন হয়ে থাকে। তাই নেফাইটিস, কিডনি ফেইলিউর ইত্যাদি রোগীদের এই রোগ সম্বন্ধে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এছাড়া গর্ভাবস্থায় রক্তচাপ বৃদ্ধি পেয়ে বাচ্চা ও মা উভয়ের জন্যই অধিকতর ঝুঁকি সৃষ্ট করে। জন্মনিয়ন্ত্রণের পিল দীর্ঘদিন সেবনের ফলে রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। এছাড়া কিছু হরমোনজনিত রোগ ও ওষুধ যেমন স্টেরয়েড দীর্ঘদিন সেবনের ফলেও উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়। কারণ যা-ই হোক, হাইপারটেনশনের রোগীদের নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।

উচ্চ রক্তচাপে করণীয়

উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসাকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-ওষুধবিহীন চিকিৎসা ও ওষুধ দ্বারা চিকিৎসা।

ওষুধবিহীন চিকিৎসা (উচ্চ রক্তচাপে করণীয়)

এ চিকিৎসা সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যদি রক্তচাপ ১৪০/৯০-এর অধিক হয়, তখনই ওষুধবিহীন চিকিৎসা শুরু করতে হবে।

  • অধিক ওজন থাকলে তা কমিয়ে স্বাভাবিক রাখতে হবে।
  • খাওয়ার লবণ যথাসম্ভব কম খেতে হবে। সুস্থ অবস্থায় একজন লোকের দৈনিক লবণ খাওয়ার পরিমাণ ১০ গ্রাম। কিন্তু উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের ৫ গ্রামের কম খাওয়া উচিত। তাই ভাতের সাথে অতিরিক্ত লবণ এবং লবণ জাতীয় খাবার পরিহার করতে হবে। আয়োডিন জাতীয় লবণ ও একইভাবে কম খাওয়া উচিত।
  • চর্বি জাতীয় খাবার, যেমন-খাসি ও গরুর গোশতের চর্বি, বিরিয়ানি, ডালডা, মাখন, পনির, ঘি ইত্যাদি যথাসম্ভব কম খাওয়া উচিত। তবে তৈলাক্ত মাছ ও উদ্ভিজ্জ তেল যেমন সয়াবিক তেল খেতে কোনো অসুবিধা নেই।
  • চা, কফি ইত্যাদি যথাসম্ভব কম পান করা উচিত। অ্যালকোহল পান থেকে বিরত থাকতে হবে।
  • হালকা ব্যায়াম, যেমন-হাঁটাচলা করা, জগিং করা, খেলাধুলা করা ইত্যাদি স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
  • অবসর কাটানো, অবকাশ যাপন করা, ধ্যান করা ইত্যাদি রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে বলে অনেকেরই ধারণা।

আরও পড়ুন- এডিনয়েড গ্রন্থির বৃদ্ধিজনিত সমস্যা

ওষুধ দ্বারা চিকিৎসা (উচ্চ রক্তচাপে করণীয়)

ওষুধবিহীন চিকিৎসার পরও সার্বক্ষণিকভাবে যদি রক্তচাপ ১৪০/৯০ এর বেশি থাকে, বিভিন্ন উপসর্গ ও হৃদরোগ বা অন্যান্য জটিলতা দেখা দেয়, তবে অবশ্যই ওষুধ দ্বারা চিকিৎসা শুরু করার অবশ্যক।

বিভিন্ন জাতীয় ওষুধ উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। তবে রক্তচাপের মাত্রা ও অন্যান্য অসুখ বা জটিলতাভেদ ওষুদের ব্যবহার পার্থক্য দেখা যায়।

  • বিটা ব্লকার জাতীয় ওষুধ, যেমন-টেনোরিন, ইনডেরাল ইত্যাদি। এ ধরনের ওষুধ সাধারণত রক্তচাপের বৃদ্ধি অল্প থাকলে ব্যবহার করা হয়। তবে হাঁপানি রোগ কারো থাকলে এ ধরনের ওষুধ ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কারো হার্ট ফেইলিউর থাকলেও তা ব্যবহার করা যায়।
  • মূত্রবর্ধক জাতীয় ওষুধ কারো ডায়াবেটিস, গাউট ইত্যাদি রোগ থাকলে ব্যবহার করা যাবে না।
  • আজকাল রক্তচাপের রোগীদের বেলায় ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার জাতীয় ওষুধ সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন-নিফিন, এমডোক্যাল, নিফিকার্ড ইত্যাদি।
  • এসিই বন্ধক জাতীয় ওষুধ যেমন-ক্যাপাটেপ্রিল, এনারিল, এসিপ্রিল ইত্যাদির ব্যবহার এখন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

১০টি উচ্চ রক্তচাপের রক্ষণ

উচ্চ রক্তচাপ, যা হাইপারটেনশন নামেও পরিচিত, এটি এখন একটি সাধারণ রোগ যা বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষকে অসুস্থ করে। এটি ঘটে যখন ধমনীর দেয়ালের বিরুদ্ধে রক্তের বল খুব বেশি হয়, যা হৃৎপিণ্ড এবং রক্তনালীগুলিতে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। যদিও উচ্চ রক্তচাপের সাধারণত কোনো উপসর্গ থাকে না, তবে এটির উপস্থিতি নির্দেশ করতে পারে এমন লক্ষণগুলি সম্পর্কে সচেতন হওয়া গুরুত্বপূর্ণ।

১০টি উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ

  1. মাথাব্যথা
    উচ্চ রক্তচাপের সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণগুলির মধ্যে একটি হল ঘন ঘন মাথাব্যথা। এই মাথাব্যথাগুলিকে সাধারণত মাথার উভয় পাশে একটি স্পন্দিত ব্যথা হিসাবে বর্ণনা করা হয় এবং এর সাথে মাথা ঘোরা বা দৃষ্টি ঝাপসা হতে পারে।
  2. শ্বাসকষ্ট
    শ্বাসকষ্ট অনুভব করা বা শ্বাসকষ্ট অনুভব করা, বিশেষত শারীরিক কার্যকলাপের সময়, উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ হতে পারে। এটি ঘটে কারণ হৃৎপিণ্ডকে ধমনীতে বর্ধিত চাপের বিরুদ্ধে রক্ত পাম্প করতে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়।
  3. বুকে ব্যথা
    বুকে ব্যথা বা অস্বস্তি উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ হতে পারে। এই ব্যথাকে বুকে আঁটসাঁটতা, চাপ বা চাপা সংবেদন হিসাবে বর্ণনা করা যেতে পারে এবং এটি ঘাড়, চোয়াল বা বাহুতে বিকিরণ করতে পারে।
  4. ক্লান্তি
    অত্যধিক ক্লান্তি বা ক্লান্তি আরেকটি উপসর্গ যা উচ্চ রক্তচাপের সাথে যুক্ত হতে পারে। এই ক্লান্তি শারীরিক এবং মানসিক উভয়ই হতে পারে এবং এটি দৈনন্দিন কাজকর্ম এবং উৎপাদনশীলতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে।
  5. দৃষ্টি সমস্যা
    উচ্চ রক্তচাপ চোখের রক্তনালীকে প্রভাবিত করতে পারে, যার ফলে দৃষ্টি সমস্যা দেখা দেয়। অস্পষ্ট দৃষ্টি, দ্বিগুণ দৃষ্টি, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে দৃষ্টিশক্তি কমে যেতে পারে।
  6. মাথা ঘোরা
    হালকা মাথা বা মাথা ঘোরা বোধ করা, বিশেষ করে যখন দ্রুত উঠে দাঁড়ায়, উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ হতে পারে। এটি ঘটে কারণ ধমনীতে বর্ধিত চাপ মস্তিষ্কে রক্ত ​​প্রবাহকে প্রভাবিত করে।
  7. নাক দিয়ে রক্ত পড়া
    যদিও নাক দিয়ে রক্ত পড়া সবসময় সরাসরি উচ্চ রক্তচাপের কারণে হয় না, তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি একটি উপসর্গ হতে পারে। আপনি যদি ঘন ঘন বা গুরুতর নাক দিয়ে রক্তপাত অনুভব করেন তবে একজন স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারের সাথে পরামর্শ করা গুরুত্বপূর্ণ।
  8. অনিয়মিত হৃদস্পন্দন
    উচ্চ রক্তচাপ হৃৎপিণ্ডের স্বাভাবিক ছন্দে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে, যার ফলে অনিয়মিত হৃদস্পন্দন বা ধড়ফড় হতে পারে। আপনি যদি আপনার হার্টের স্পন্দন অনিয়মিতভাবে বা স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুত দেখেন, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া অপরিহার্য।
  9. ফোলা
    ফোলা, বিশেষ করে পা, গোড়ালি বা পায়ে, উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ হতে পারে। রক্তনালীতে অতিরিক্ত চাপের ফলে আশেপাশের টিস্যুতে তরল বের হয়ে গেলে এডমা নামে পরিচিত এই ফোলাভাব ঘটে।
  10. ফ্লাশিং
    উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত কিছু ব্যক্তি মুখে ফ্লাশ বা লালভাব অনুভব করতে পারে। এটি একটি অস্থায়ী লক্ষণ হতে পারে যা রক্তনালীতে রক্ত ​​প্রবাহ এবং চাপ বৃদ্ধির কারণে ঘটে।

আপনি যদি এই উপসর্গগুলির মধ্যে কোনটি অনুভব করেন তবে সঠিক নির্ণয়ের জন্য একজন চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জীবনযাত্রার পরিবর্তন, ওষুধ এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আপনার স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং জটিলতার ঝুঁকি কমাতে আপনার রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।

একটা কথা প্রায়ই ওঠে যে, হাইপারটেনশনের চিকিৎসা কত দিন চালাতে হবে। এই রোগের চিকিৎসা আমৃত্যু চালানো উচিত। শুধু মাঝে মাঝে ১-২ মাস পর পর রক্তচাপের মাত্রা দেখা উচিত এবং রক্তচাপের মাত্রার সাথে ওষুধের মাত্রা মিলিয়ে দেখতে হয়। এক ওষুধে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ না হলে একের অধিক ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে সব ক্ষেত্রেই ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কি না তা দেখে নিতে হবে। পাশাপাশি হার্টের রোগ, মস্তিষ্কের রোগ, কিডনিজনিত রোগ আছে কি না তাও মাঝে মাঝে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন।

উচ্চ রক্তচাপে করণীয় যা হলো অনেকেই ওষুধ খাওয়া অবস্থায় রক্তচাপ স্বাভাবিক হয়ে এলে ওষুধ বন্ধ করার চিন্ত করে থাকেন এবং কেউ কেউ প্রায়ই ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেন, যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। কারণ এতে রোগীদের টার্গেট গ্রন্থিসমূহের জটিলতা দেখা দিয়ে হার্ট এটাক, স্ট্রোক ইত্যাদি হতে পারে। হঠাৎ করে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে।

অতএব, এ কথা সহজেই অনুমেয় যে উক্ত রক্তচাপের রোগীর চিকিৎসা নিয়মিত করতে হবে। কখনোই কোনো অনিয়ম করা হলে তা রোগীর জন্য খুবই ক্ষতিকর হবে। ওষুধ ও ওষুধবিহীন, উভয় প্রকার চিকিৎসাই সব রোগীর ক্ষেত্রের প্রযোজ্য। নিয়মিত চিকিৎসার ফলে রোগী দীর্ঘদিন সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। বাচ্চা বয়সেও উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। বিশেষ করে যদি কারো কিডনিজনিত রোগ যেমন নেফ্রাইটিস, কিছু হরমোন গ্রন্থির রোগ যেমন-ফিওকোমসাইটোম ইত্যাদি থাকে। তাই শিশু রোগীদেরও মাঝে মাঝে রক্তচাপ মেপে দেখা উচিত।

Share your love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *