ডেঙ্গু একটি ভাইরাল সংক্রমণ যা সংক্রামিত মশার কামড়ের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সংক্রামিত হয়। প্রাথমিক বাহক যেগুলি ডেঙ্গু রোগটি ছড়ায় তারা হল এডিস ইজিপ্টি মশা এবং কিছুটা কম পরিমাণে Ae। albopictus ডেঙ্গু হওয়ার জন্য দায়ী ভাইরাসকে ডেঙ্গু ভাইরাস (DENV) বলা হয়।
ডেঙ্গু জ্বর কী ধরনের রোগ?
ডেঙ্গু হলে করণীয় কি? ডেঙ্গু ভাইরাস এডিস মশা বাহিত গ্রীষ্মমন্ডলীয় রোগ। ডেঙ্গু ভাইরাস এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের তিন থেকে পনেরো দিনের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলো দেখা দেয়। ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলির মাঝে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, বমি, পেশিতে ও গাঁটে ব্যথা এবং গায়ের চামড়ায় র্যাস অথবা ফুসকুড়ি। স্বাভাবিকভাবে ডেঙ্গু রোগী রোগী দুই থেকে সাত দিনের মাঝে আরোগ্য লাভ করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগটি মারাত্মক রক্তক্ষরণের রূপ নিতে পারে। যার ফলে রক্তপাত হয়, রক্তের অনুচক্রিকার মাত্রা কমে যায়, রক্ত প্লাজমার নিঃসরণ ঘটে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডেঙ্গু শক সিনেড্রোমে রক্তচাপ অনেক কমে যায়।

ডেঙ্গু জ্বরের চিহ্ন
সাধারণভাবে ৮০% ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীরা উপসর্গবিহীন। সাধারণ যেমন জ্বর হয় সামান্য উপসর্গ। বাকিদের মধ্যে ৫% রোগীর জ্বর জটিলভাবে দেখা দেয় এবং প্রাণঘাতী হয়। উপসর্গসমূহের সূত্রপাত থেকে রোগের প্রাথমিক পর্যায়ের মধ্যবর্তী সময় স্থায়ী হয় ৩-১৪ দিন, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তা ৪-৭ দিন। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে প্রায়শই উপসর্গগুলি হয় সাধারণ সর্দি এবং গ্যাস্ট্রোএন্টারাটাইটিস। সেক্ষেত্রে বমি ও ডায়েরিয়া হয়। বড়দের চেয়ে উপসর্গের তীব্রতা কম হয়। কিন্তু রোগের জটিলতার শিকার বেশি পরিমাণে হয়।
পর্যায়
প্রথম পর্যায়ে থাকে অনেক জ্বর, প্রায় (১০৪) ফারেনহাইটের এর বেশি, সঙ্গে থাকে সাধারণ ব্যথা ও মাথাব্যথা। এটি সাধারণত-দুই থেকে সাতদিন স্থায়ী হয়। এই পর্যায়ে ৫০-৮০% উপসর্গে র্যাশ বেরোয়। এটা উপসর্গের প্রথম বা দ্বিতীয় দিনে লাল ফুসকুড়ি হিসাবে দেখা দেয়, বা পরে অসুখের মধ্যে (দিন ৪-৭) হামের মতো র্যাশ দেখা দেয়। কারও কারও মুখ ও নাকের মিউকাস মেমব্রেন থেকে অল্প রক্তপাতও হতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরের কারণ
ডেঙ্গু ভাইরাস প্রাথমিকভাবে এডিস মশা দ্বারা পরিবাহিত হয়। এই ভাইরাসের প্রাথমিক ধারক মানুষ কিন্তু মানুষ ছাড়া অন্য প্রাইমেটিদেরদের মধ্যেও সংক্রামিত হয়। একবারের কামড়ে যে কেউ সংক্রমণ হতে পারে। স্ত্রী মশা ডেঙ্গু আক্রান্তের রক্তপান করে নিজে সংক্রমিত হয় ও পেটে ভাইরাস বহন করে। প্রায় ৮-১০ দিন পর ভাইরাস মশার দেহের অন্যান্য কোষে ছড়িয়ে পড়ে যার মধ্যে আছে মশার লালাগ্রন্থি এবং শেষে এর লালায় চলে আছে। সারা জীবনের জন্য আক্রান্ত হলেও মশার উপর এই ভাইরাসের কোনো ক্ষতিকারক প্রভাব পড়ে না। এডিস মশা জিকা, চিকুনগুনিয়া এবং অন্যান্য ভাইরাসও ছড়ায়। ডেঙ্গু ভাইরাসের চার ধরনের সেরোটাইপ আছে। কোন ব্যক্তি যে ভাইরাস দ্বারা প্রথমে আক্রান্ত হয়, সেই ভাইরাসের বিরুদ্ধে তার দেহে প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি হয়। এজন্য কোনো ব্যক্তি তার জীবদ্দশায় চার বারের মতো ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। যারা আগেও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে ডেঙ্গু হলে তা মারাত্বক হওয়ার ঝুঁকি থাকে। ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশা কোন ব্যক্তিকে কামড়ালে, সেই ব্যক্তি ৪ থেকে ৬ দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়। এবার এই আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোন জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে, সেই মশাটিও ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবে একজন থেকে অন্য জনে ডেঙ্গু ছড়িতে পড়ে।
সময়কাল
সাধারণভাবে জুলাই থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ থাকে। কারণ এ সময়টিতে এডিস মশার বিস্তার ঘটে। কিন্তু কিছু কিছু সময়ে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই দেখা দিয়েছে।
ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গ
প্রধানত লক্ষণগুলো হলো- পেট ব্যাথা, বমি, যকৃৎ বড় হয়ে যাওয়া, পেশিতে রক্তক্ষণ, অনুচক্রিকা কমে যাওয়া। ডেঙ্গু রোগের ডেঙ্গু উপসর্গের মধ্যে প্রথমত হঠাৎ জ্বর হওয়া, দু’চোখের মাঝে মাথাব্যথা, মাংশপেশি ও হাড়ের মধ্যে ব্যথা এবং ফুসকুড়ি বা র্যাশ বেরোনো। ডেঙ্গুর অন্য নাম “হাড়-ভাঙা জ্বর” যা এই মাংশপেশি ও হাড়ের সংযোগস্থলে ব্যথা থেকে এসেছে। মেরুদন্ড কোমরে ব্যথা হওয়া এ রোগের বিশেষ লক্ষণ।
পরীক্ষা নিরীক্ষা
অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডেঙ্গু জ্বর হলে খুব বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার দরকার নেই। জ্বরের ৪ থেকে ৫ দিন পরে সিবিসি এবং প্লাটিলেট করাই যথেষ্ট। এর আগে করলে রিপোর্ট স্বাভাবিক থাকে এবং বিভ্রান্ত হতে পারেন। প্লাটিলেট কাউন্ট ১ লক্ষের কম হলে, ডেঙ্গু ভাইরাসের কথা মাথায় রেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া উচিত। ডেঙ্গু এন্টিবডির পরীক্ষা ৫ থেকে ৬ দিনের পর করা যেতে পারে। তবে রোগ সনাক্তকরণে সাহায্য করলেও চিকিৎসায় সরাসরি এর কোনে ভূমিকা নেই। প্রয়োজনে ব্লাড সুগার, লিবারের পরীক্ষাসমূহ যেমন এসজিপিটি, এসজিওটি, এলকালাইন ফসফাটেজ ইত্যাদি করা যেতে পারে। রোগের তীব্রতা বেধে চিকিৎসক অন্যান্য পরীক্ষা করার পরামর্শ দিবে।

প্রতিকার
ডেঙ্গু হলে করণীয়: ডেঙ্গু ভাইরাসের কোন স্বীকৃত টিকা ভ্যাকসিন নেই। সুতরাং প্রতিরোধ নির্ভর করে জীবাণুবাহী মশা নিয়ন্ত্রণ এবং তার কামড় থেকে সুরক্ষার উপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পাঁচটি মৌলিক দিশাসমেত সংবদ্ধ মৌলিক দিশাসমেত সংবদ্ধ একমুখী নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচীর সুপারিশ করেছে:
- এটিকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রাথমিক পদ্ধতি হলো এর বৃদ্ধির পরিবেশকে ধ্বংস করে ফেলা।
- জলের আধার খালি করে অথবা কীটনাশক প্রয়োগ করে।
- এডিস মশা সাধারণত সকাল ও সন্ধ্যায় কামড়ায়। তবে অন্য সময়ও কামড়াতে পারে। তাই শরীর কাপড়ে ঢেকে বের হতে হবে। নির্ধারিত স্থানে কীটনাশক স্প্রে করা। [কীটনাশক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে]
- জমে থাকা ফুলের টবে বা জমে থাকা খোলা পাত্রের পানিতে মশকী ডিম পাড়ে। পোষা প্রাণির খাবার পাত্র, পানির পাত্র, ফুল গাছের টব, নারকেলের মালা, ফুলদানি, অব্যবহৃত কৌটা, ডাবের খোসা, পরিত্যক্ত টায়ার, খোলা একুরিয়াম, ফ্রিজ বা এয়ার কন্ডিশনের ইত্যাদিতে পানি জমা জায়গায় পানি কম জমা নিয়ন্ত্রণ।
- পুরো শরীর শরীর ঢাকা পোশাক পরে, বিশ্রামের সময় মশারি ব্যবহার করে এবং কীট প্রতিরোধক রাসায়নিক ব্যবহার করে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা সম্ভব।
- সর্বপরি, প্রচার, সামাজিক সংক্রিয়তা, এবং জনস্বাস্থ্য সংগঠন ও সমুদায়সমূহকে শক্তিশালী করা।
চিকিৎসা
ডেঙ্গু হলে করণীয় হলো ডেঙ্গু জ্বরের কোন নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। রোগের লক্ষণের উপর চিকিৎসা নির্ভর করে। বাড়িতে নিয়মিত দেখাশোনার সঙ্গে ওরাল রিহাইড্রেশন থেরাপি থেকে শুরু করে হাসপাতালে ভর্তি করে ইন্ট্রাভেনাস থেরাপি। এটি নির্ভর করে “বিপদসূচক চিহ্ন” এর উপর, যাদের স্বাস্থ্যের সমস্যা আগে থেকেই আছে। বেশিরভাগ লোকই কোন স্থায়ী সমস্যা ছাড়াই ডেঙ্গু থেকে আরোগ্যলাভ করে। মৃত্যুহার চিকিৎসা ছাড়া ১-৫%, পর্যাপ্ত চিকিৎসায় ১%-এরও কম। তবে রোগের চরম পর্যায়ে মৃত্যুহার ২৬%।
সবশেষে ১১০টিরও বেশি দেশে ডেঙ্গু মহামারীর আকার নিয়েছে। সারা পৃথিবী জুড়ে বছরে ৫০ থেকে ১০০ মিলিয়ন লোকের মধ্যে এটি সংক্রামিত হয়, যার মধ্যে ৫ লক্ষকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় এবং প্রায় ১২৫০০-২৫০০০ মৃত্যু ঘটে। ডেঙ্গু হলে করণীয় আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে এটির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য।
আরও পড়ুন- কলেরা প্রতিরোধে করণীয়